সুখ ও দুঃখ কী, কয়েক শব্দে জানালেন ১৩৩ বছরের সাধুবাবা।উত্তরাখণ্ডে যাত্রাপথের শুরু হৃষীকেশ থেকে। যাত্রা শুরু করেছি বাসে। পেরিয়ে এসেছি নরেন্দ্রনগর। এ পথ আমার পরিচিত। একসময় এ পথ দিয়ে গিয়েছি যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, কেদার ও বদরীনারায়ণ। জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে, ভাবছি, তখন আমার সঙ্গী ছিল তিনজন। সংসারঅরণ্যে তারা সবাই হারিয়ে গেছে বহুবছর আগে আবারও চলেছি সেই পথে।হিমালয়ের রূপরাজ্যে প্রবেশ করেছি ধীরে ধীরে। যত যাচ্ছি ততই ভেসে আসছে পাহাড়ি অরণ্যের জংলি মিষ্টি গন্ধ। এ গন্ধও আমার পরিচিত, নির্ঝরিণী গঙ্গার নূপুর ধ্বনিও। হৃষীকেশের পর থেকে সমতলের বিস্মৃতি হারিয়ে ক্রমশ উঠতে লাগলাম উপরে।একটানা চলে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে বাস এল ধরাসু। এখান থেকে উত্তরকাশীর পথে পেলাম গঙ্গাকে। নিয়ে চলেছি ডান হাতে। রূপবতী গিরিতনয়া বয়ে চলেছে কোমর দুলিয়ে, এঁকেবেঁকে। উচ্ছল যৌবনা পাহাড়ি মেয়ে যেন। চারদিকে স্তরে স্তরে পাহাড়ের পর পাহাড়ের শিখরাবলী। হিমালয়ের গিরিশ্রেণি সবুজে মোড়া। এখানকার পাহাড় হিমল নয়, তবে কোনও কোনও অংশের নিরাবরণতায় নানা রঙের সংমিশ্রণ মুগ্ধ করে মনকে। একবারে নিচে বয়ে চলেছে নির্ঝরিণী ভাগীরথীগঙ্গা।ধরাসু থেকে একনাগাড়ে চলে বাস এসে থামল উত্তরকাশী ‘বাস আড্ডায়’। পাহাড়িয়ারা কেউ বাসস্ট্যান্ড বলে না, বলে বাস আড্ডা। হৃষীকেশ থেকে উত্তরকাশী ১৫৫ কিমি। উচ্চতা ৩৮০০ ফুট। সময় লাগল প্রায় পাঁচঘণ্টা। আপাতত এখানেই আমার যাত্রাপথের শেষ। উত্তরকাশীতে হিমালয় যেন যোগীরাজ। এর শান্ত মূর্তি ধ্যানস্তিমিত মহামৌন। এখানে গাছপালায় জটলা নেই ঘেঁষাঘেঁষি করে। উত্তরকাশীর বুক চিরেই বয়ে চলেছে গিরিনন্দিনী। অসংখ্য শিলাখণ্ডের অবরোধ অতিক্রম করে জললহরী ছুটে চলেছে হরিদ্বারের পথে। পাহাড়িঢালে সুশোভন অরণ্য। নিবিড় বনের ভিতর দিয়ে পথ উঠেছে এঁকেবেঁকে। এ এক চোখজুড়ানো অনুপম দৃশ্য।লোকসমাগম বেড়েছে তবে হিমালয়ে রূপরাশির ঘাটতি নেই এতটুকু। অতি প্রাচীন তীর্থ এই উত্তরকাশী। অর্ধচন্দ্রাকারে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে উত্তরবাহিনী গঙ্গা। মা যেমন বাহুডোরে আগলে রাখে সন্তানকে তেমনই গঙ্গা যেন আগলে রেখেছে উত্তরকাশীকে। কত যে সাধুসন্ন্যাসী, যোগী, ঋষি বিমুক্তকামী হয়ে তপস্যা করেছিলেন উত্তরকাশীর নিভৃতে, তার ইয়ত্তা নেই।বাসস্ট্যান্ডের পিছনের একটা রাস্তা ধরে এগোলাম। খানিকটা যেতেই এল বাবা কালীকমলি ধর্মশালা। সহজে ঘর পেলাম। সামান্য ভাড়া। আর পাঁচটা ধর্মশালার মতো নয়।এখানে দিনের মতো রাতটাও কেটে যায় দেখতে দেখতে। তবে ঘুম ভেঙে যায় আঁধার থাকতে। উঠে বসি। পাশেই গঙ্গা। তুষার শীতল গঙ্গার কলধ্বনি আচ্ছন্ন করে তোলে মনকে। মোহিত হয়ে দেখি শৈলশ্রেণির জটাজাল ভেদ করে তরতরিয়ে নেমে আসা গঙ্গাকে। ঢেউ-এর খাঁজে চাঁদের আলো পড়ে আলোআঁধারি ভাগীরথী হয় মোহিনীরূপী। এ এক নয়নাভিরাম প্রতিদিনের ভোররাত্রি।সকাল হয়। বেরিয়ে পড়ি ঘুরতে। উত্তরকাশীর বাজারের মধ্যে দিয়ে শুরু হল চলা। স্থানীয় দোকানদারদের জিজ্ঞাসা করে, এদিক সেদিক করতে করতে এল উত্তরকাশীর আদালত। এরপাশ দিয়ে আরও খানিক এগিয়ে এলাম ভৈরব চকের কাছে বিশ্বনাথ মন্দিরের সামনে। প্রবেশদ্বার পার হতেই ডানদিকে প্রথমে পড়ল ছোট্ট একটি মন্দির। ভিতরে স্থাপিত মূর্তিটি গণেশের। কুচকুচে কালো। প্রাচীনতত্ত্বের ছাপ এর সারা অঙ্গে। এটির পাশে ধবধবে সাদা গণেশের একটি বিগ্রহ।মন্দিরচত্বরের ডানদিকে একটি টিনের ছাউনি। এর নিচে অনেকটা জায়গাজুড়ে বেশ কয়েকটি যজ্ঞকুণ্ড। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন কয়েকজন সাধুবাবা। বিপরীতের মন্দিরটি শক্তিমন্দির নামে অভিহিত। ভিতরে পোঁতা একটি ত্রিশূল। সামনে উত্তরকাশীর বিশ্বনাথ মন্দির। উখিমঠ বা কেদারনাথ মন্দিরের আদলে নির্মিত।বসে থাকা সাধুবাবাদের বাইরে একটু দূরে, একটু আলাদাভাবে বসে আছেন একজন অতিবৃদ্ধ সাধুবাবা। গায়ের রং শ্যামবর্ণ না বলে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলাই ভালো। অনন্তকালের সঙ্গী ঝোলাটা রয়েছে বাঁপাশে, তার উপরে ভাঁজ করা কম্বল। গরম নেই বলে গায়ে গেরুয়া ফতুয়া। গলায় না রুদ্রাক্ষের, না স্ফটিকের, কোনও মালাই নেই। বুঝলাম, যাদের রূপ নেই তারাই বেশি সাজনগোজন করে রূপসী হতে। আরও বুঝলাম, নিজেকে গোপন করতেই সাধুবাবার সাজহীন দেহ। যার রূপ আছে তার সাজের প্রয়োজন হয় না। যার নেই সে রংচং পরচুলো দিয়ে নিজেকে আকর্ষিত করতে চায়। এই সাধুবাবার বাইরেটা দেখে মনে হল, এ চায় না তাকে কেউ চাক। কপাল আর গোটা মুখখানা বলিরেখায় জর্জরিত। সারা দাড়িতে যেন দই মাখানো। টানটান নাক। গজ কপাল। মাথার মাঝ বরাবর টাক, বাকিটা অল্প চুলে ভরা হলেও দু-চারটে খয়েরি জটা দু-কাঁধ আর পিঠে ছড়িয়ে পড়ে যেন ফিকফিক করে হাসছে। মোটের উপর কলপের যুগ হলেও এদেহে কোনও কৃত্রিমতা নেই। বয়েসে বৃদ্ধ তবে কত বৃদ্ধ তা আন্দাজ করতে পারলাম না। অনেক সময় বিগত যৌবনা রমণীর বয়েস কিছুতেই আন্দাজ করা যায় না। দেহের বাঁধুনি ও সাজসজ্জার গুণে। সাধুবাবার এসব ব্যাপার না থাকলেও বয়েসটা আমার একেবারেই অনুমানে এল না।এগুলি দেখলাম সাধুবাবা যেখানে বসে আছেন সেখান থেকে হাতদশেক দূরে দাঁড়িয়ে। কোনও দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। স্থির হয়ে বসে আছেন আপনভাবে। আমি আর দেরি করলাম না। ঝড়ের বেগে কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই দু-হাত মাথায় দিয়ে মুখে বললেন, ‘ওঁ নমঃ নারায়ণায়’। তারপর আমার ব্রহ্মতালু ও দু-গালে চুমু দিয়ে বললেন,– বইঠ্ বেটা, বইঠ্। অভি তু কহা সে আয়ে, যাওগে কহা?প্রথম থেকেই বৃদ্ধ আমাকে এমনভাবে আদরে গ্রহণ করবেন, এ আমার কল্পনারও বাইরে, হৃদয় মন আমার ভরে উঠল আনন্দে। অনেক সময় রাগি স্বামী বা স্ত্রীকে মিষ্টি কথা বলে, কয়েক গ্যালন তেল মাখিয়ে পরে পিরিতের জীবন শুরু করতে হয়। এক্ষেত্রে তা করতে হল না। এ আমার গর্ভধারিণী মায়ের প্রাণ উজাড় করা আশীর্বাদের ফল। সংসারজীবনে বাবার অবদানকে কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না, তা আমি করিনা কখনও, তবে এক কথায় আমার অভিমত যে কোনও নারী বা পুরুষের জীবনে মায়ের অবদান এক ও অদ্বিতীয়। এখানে ভগবান বলে যদি কিছু থাকে তবে তাঁরও প্রবেশাধিকার নেই। দুগ্ধপোষ্য ছোট্ট শিশুর মুখে গর্ভধারিণী মায়ের স্তনযুগলই ক্ষুধানিবৃত্তি করে, সেখানে কোনও মন্দিরের দেবী এসে স্তন্যপান করিয়েছে বলে আমার জানা নেই। যাইহোক, আমার এই ছাল ছাড়ানো ডাকপাখির মতো চেহারাটাকে বৃদ্ধ এইভাবে গ্রহণ করবেন তা আমি ভাবতে পারিনি। সাধুবাবার সামনে বসলাম মুখোমুখি হয়ে। পরে অন্য কথা হবে। এখন প্রথম জিজ্ঞাসা,– বাবা, আপনাকে প্রণাম করতেই আপনি আমার ব্রহ্মতালুতে ও দু-গালে আদর করে চুমু খেলেন। এর কি কোনও আলাদা আধ্যাত্মিক অর্থ আছে?কথাটা শোনামাত্রই অতিবৃদ্ধ এই সাধুবাবা বললেন,– হাঁ হাঁ বেটা, জরুর হ্যায়। ব্রহ্মতালুতে চুমু খেলে গ্রহের দোষ কিছু নিতে হয়। তোকে আমার ভালো লেগেছে তাই গ্রহের দোষ কিছু গ্রহণ করে তোকে কিছু দুর্ভোগের হাত থেকে মুক্ত করলাম। তোকে সন্তানজ্ঞানে অন্তরে গ্রহণ করেছি বলে গালে চুমু দিলাম। এটা তোকে আমার আশির্বাদি চুমু, বুঝেছিস?মাথাটা নেড়ে বললাম বুঝেছি। অন্যের এঁটো খেলে তাঁর গ্রহদোষ মুহুর্তে সংক্রামিত হয় দেহমনে এটা আমার জানা ছিল পুরাণ ও সাধক মহাপুরুষদের জীবনী পড়ে। ব্রহ্মতালুতে চুমু খেলে যে অন্যের গ্রহদোষ দেহমনকে সংক্রামিত করে তা আজ জানলাম। আমি কিছু বলার আগেই বৃদ্ধ বললেন,– বেটা তুই কোথায় থাকিস? গঙ্গোত্রীতে গঙ্গামাঈর দর্শন করে কি উত্তরকাশীতে এলি?এত মিশুকে সাধুবাবা তা বাইরে থেকে দেখে এতটুকু বোঝার উপায় নেই। প্রসন্ন মুখমণ্ডল। এমন গহন দু-চোখ কোনও মানুষের হয় বলে মনে হয় না, তবে দেবদেবীদের মূর্তি ও ছবিতে দেখেছি। বলিরেখার উৎপাতে ভরা মুখমণ্ডলে বৃদ্ধের এমন ফিনফিনে ঠোঁট কোনও মেয়ের হয় কিনা জানা নেই, তেমন কোনও রমণী আজও আমার চোখে পড়েনি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, কোনও এক বিশেষ কারণে আমার গুরুর কাছে থেকে (দীক্ষাগুরু নয়) পুরুষ ও রমণীদেহের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত নানান ফলাফল সামান্য কিছু জেনেছি। তাই যখন যে সাধুবাবার কথা লিখি তখন চেষ্টা করি তাঁর দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে। বর্ণনায় তার অন্তর্নিহিত ফলাফলটা অন্তরে অনুভব করে পুলকিত হই, সেটা সাধুছাড়াও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও। যাইহোক, জিজ্ঞাসার উত্তরে বললাম,– বাবা, আগে আমি তিনবার গঙ্গোত্রীতে গঙ্গামাঈর দর্শন করেছি। আজ উত্তরকাশী ঘুরব বলেই এসেছি। গঙ্গোত্রী যাব না (আজ লিখতে বসে পাঠককে জানাই, গঙ্গোত্রীতে গিয়েছি মোট বারোবার। আবারও যাওয়ার ইচ্ছা আছে)। এখান থেকে ফিরে যাব হরিদ্বারে। এসেছি কলকাতা থেকে।সাধুবাবা আমার কথা শুনে বেশ খুশি হলেন বলে মনে হল। কাঁচাপাকায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন,– বেটা, এখন তুই কি করিস? বয়েস কত হল? বিয়ে থা করে কি সংসার করছিস? মাথাভর্তি চুল আর গালভর্তি দাড়ি, তুই কি কোনও আশ্রমে থেকে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করছিস? আমি জানি তোর অনেক জিজ্ঞাসা। আগে তোরটা জেনে নিই পরে আমারটা বলব। বেটা, প্রতিটা নারীপুরুষের অন্তরে অনেক কথা, অনেক জিজ্ঞাসা থাকে। সব কথা সবাইকে বলতে পারে না মনের মতো কাউকে না পেলে। স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকেও বলতে পারে না একে অপরের অন্তরজুড়ে না বসলে। তোকে আমার ভালো লেগেছে। যা জিজ্ঞাসা করবি তা সব বলব তবে তোর কথাটা আগে জেনে নিই।মনে মনে বললাম, পোড়াকপাল আর কাকে বলে? সারাজীবন নির্বিকার নির্লিপ্ত আত্মভোলা সাধুমহাপুরুষদের ভালোবাসা ও আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই জুটল না কপালে। ও দিয়ে আমার হবেটা কি, পেট ভরবে? সাধুবাবার জিজ্ঞাসার উত্তরে কি কাজে লিপ্ত আছি তা জানিয়ে বললাম,– বাবা, এখন আমার বয়েস উনত্রিশ। বিয়ে করিনি কারণ তেমন রোজগার কিছু নেই। চুল দাড়িটা একটা বিশেষ কারণে রেখেছি। আমি এক কুমারী সন্ন্যাসিনী মায়ের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছি যিনি বারোবছর অসূর্যম্পশ্যা ছিলেন। তাঁর কাছে যাতায়াত আছে তবে ভুল করেও আমি সাধু নই।এই পর্যন্ত বলে থামলাম। সাধুবাবা মাথা দোলাতে লাগলেন। এবার আমি শুরু করলাম,– বাবা, এখন আপনার বয়েস কত? কত বছর বয়েসে গৃহত্যাগ করেছেন? আপনি কোন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী? বরাবর উত্তরকাশীতেই থাকেন না অন্য কোথাও ডেরা আছে আপনার?কথাগুলো শুনলেন মন দিয়ে। মুখমণ্ডলের বলিরেখা দেখে বয়েসটা আন্দাজ করতে পারিনি বলে ওটাই ছিল প্রথম জিজ্ঞাসা। অতিবৃদ্ধ সাধুবাবা বললেন,– এখন আমার বয়েস একশো তেত্রিশ বছর চলছে। গৃহত্যাগ যখন করেছিলাম তখন আমার মনে হয় বয়েস বছর পনেরো। আমার পাঞ্জাবী দেহ। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে আমার জন্ম। আমি দশনামী গিরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। মূল আস্তানা হরিদ্বারে তবে আমি খুব কমই যাই সেখানে। যখন মন চায় তখন উত্তরাখণ্ডে বিভিন্ন তীর্থে ঘুরে বেড়াই।বয়েসটা শুনে একটু চমকে গেলাম। নৈমিষারণ্যে ১৩০ বছরের সাধুবাবা স্বামী নারদানন্দ তীর্থের সঙ্গ করেছিলাম ১৯৮০ সালে। জিজ্ঞাসা করলাম,– উত্তরকাশীতে আছেন কত দিন? এখানে তো আপনার কোনও ডেরা নেই, রাতে থাকেন কোথায়?উত্তরে বৃদ্ধ জানালেন,– এখানে আছি মাস ছয়েক। রাতে এই মন্দিরাঙ্গনেই পড়ে থাকি। ভোলেনাথ কি কৃপাসে প্রতিদিন খাবার কিছু জুটে যায়। এইভাবে চলছি, এখন এ ভাবেই চলে আমার।জানতে চাইলাম,– বাবা, তখন কত কম বয়েস আপনার। ওইটুকু বয়েসে কিসের টানে, কি পাওয়ার আশায় গৃহত্যাগ করেছিলেন?সাধুবাবা একভাবে বসে আছেন। মুখোমুখি আমি। বললেন,– বেটা, আজও আমার মনে আছে। গাঁয়ের ছোট পাঠশালায় পড়ি। একদিন গুরুমশাই পড়া শেষ হলে বললেন, ‘তোমরা প্রতিদিন পড়াশুনো যেমন করছ, তেমনই করবে তবে সর্বশক্তিমান ভগবানকে পাওয়ার জন্য সচেষ্ট হবে।’ আমি তখন বললাম, ‘ভগবানকে কোথায় পাওয়া যাবে?’ গুরুমশাই বললেন, ‘তা তো আমি বলতে পারব না। তবে তাঁকে লাভ করার রাস্তাটা সাধু মহাত্মারাই বলতে পারেন।’ ব্যস বেটা, কথা হল এইটুকু। পাঠশালা ছুটির পর আর বাড়ি ফিরে গেলাম না। বেরিয়ে পড়লাম মহাত্মার সন্ধানে। সোজা স্টেশন এলাম। মাথায় তখন আর কোনও ভাবনাই নেই। ট্রেন আর পায়ে হেঁটে একদিন পৌঁছলাম ‘জ্বালাজিতে’ (অবাংলাভাষিরা অধিকাংশই দেবীতীর্থ জ্বালামুখীকে জ্বালাজি বলে থাকেন)। এই মায়ের নাম আমার শোনা ছিল। পথ জানা ছিল না। এখানে দিন কয়েক থাকার পর এক বৃদ্ধ মহাত্মার সন্ধান পেলাম। প্রথম থেকে ব্যাপারটা ঘটে চলল অদৃশ্য কোনও এক মহাশক্তির আকর্ষণে, বিশেষভাবে। ওই মহাত্মার আস্তানা ছিল বেনারসে। একসময় ওই মহাত্মাই আমার গুরুজি হলেন। জীবনের গতিপথ গেল বদলে। এ যে কেন হল, কি জন্যে হল তা আজও বুঝে উঠতে পারি না। বেটা, ভেবে কিছু হয় না। কিছু ভাববি না। ভাবনাটা তাঁর উপরে ছেড়ে দে। দেখবি্ তোর জীবনগাড়ি পেট্রোল ছাড়াই চলছে। এ গাড়ি গুরুজি নিজে চালান, নিজেই পেট্রোল হন, তাঁর সন্তান গুরুর গাড়িতে (কোলে) বসে সারাজীবন চলে আরামে।সাধুবাবা থামলেন। মুখখানা দেখে মনে হল কিছু একটা ভাবছেন। কোনও কথা বলে ভাবটা নষ্ট করলাম না। প্রথম প্রথম সাধুদের ভাবটা বুঝতে বা ধরতে না পেরে বোকার মতো প্রশ্ন করে ভাবের তারটা প্রায়ই কেটে দিতাম। এখন অনেকটাই অভ্যস্ত তাই আর ওই ভুলটা হয় না। কি ভেবে চলছেন তা জানি না তবে আপনভাবেই বললেন,– বেটা, সারা পৃথিবীর প্রতিটা নারীপুরুষই সুখ পেতে চায় একান্তভাবে। সংসারীরা এতটুকু দুঃখ চায়না কেউই। কিন্তু মানুষ কত বোকা, দুঃখ যে সুখেরই অগ্রদূত তা কেউ জানে না, ভাবেও না একবার। জীবনে সুখ দুঃখ কী, কয়েকটি কথায় বুঝিয়ে দিলেন ১৩৩ বছরের এক তপস্বী।ব্যুরো রিপোর্ট।